মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারন (Causes of the Downfall of the Mughal Empire)


মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারন (Causes of the Downfall of the Mughal Empire :

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে উইলিয়াম আরভিন,স্মিথ,স্যার যদুনাথ, ঈশ্বরী প্রাসাদ প্রমুখ প্রাচীন ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের বিশালতা ঔরঙ্গজেবের ধর্মনিীতি, দাক্ষিণাত্য নীতি,
পরবর্তী মোগল সম্রাটদের দুর্বলতা ও ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, অভিজাতদের নৈতিক বিভিন্ন মতবান অধঃপতন, সেনাবাহিনীর দুর্বলতা ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রভৃতির কথা বলেন। আধুনিক ঐতিহাসিকরা উপরিউক্ত কারণগুলিকে গুরুত্ব দিলেও, তাঁরা নতুন কিছু কারণের উল্লেখ
করেছেন। তাঁদের মতে, এ সময় মোগল সাম্রাজ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ---
এমন কতকগুলি সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিল, যা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। ড, সতীশ চন্দ্ৰ,আতাহার আলি, ইরফান হাবিব, মুজাফফর আলম, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিক মোগল দরবারে দলাদলি, জায়গীরদারী সমস্যা কৃষিসঙ্কট ও কৃষক বিদ্রোহ প্রভৃতি কারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।
(১) বিশালতা : মোগল সাম্রাজ্যের বিশালতা তার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আকবরের আমলে যে সাম্রাজ্যবাদী নীতির সূচনা হয়, ঔরঙ্গজেবের আমলে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ঐ দিনে দিল্লী থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায়
রাখা সত্যই খুব দুরূহ ছিল। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রায়ই দিল্লীর কর্তৃত্বের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করত। দূরবর্তী প্রদেশগুলির এইসব বিদ্রোহ দমন সত্যই খুব কষ্টসাধ্য ছিল।
(২). উওরাধিকার-সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব : মোগলদের কোন সুস্পষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না।
এই কারণে কোন সম্রাটের মৃত্যু হলে তার সব পুত্ৰই সিংহাসনের দাবিদার হতেন এবং সাম্রাজ্যে
উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত ভ্ৰাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব শুরু হত। শাহজাহানের জীবদ্দশাতেই তার পুত্ররা এ ধরনের
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব তার সকল ভ্রাতাকে হত্যা করে সিংহাসনে
বসেন। উরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এ ধরনের ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ প্রবল আকার ধারণ করে এবং ১৭০৭
থেকে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ–মাত্র তের বছরের মধ্যে ছয় জন সম্রাট সিংহাসনে বসেন। এদের মধে
কেবল বাহাদুর শাহ ও মহম্মদ শাহ ব্যতীত সকলেই নিহত হন। বিভিন্ন আমীর-ওমরাহ ও রাজকর্মচারীরা এইসব দ্বন্দ্বে  অংশগ্রহণ করলে অবস্থা জটিলতর হয়ে ওঠে (he prolonged anarchy involved in the repeated wars of succession was a potent influence
in bringing about the ruin of the imperial fabric."---V. A. Smith, Oxford History of India, 1928, P. 466)।

(৩). দুর্বল উওরাধিকার : মোগল সাম্রাজ্য স্বৈরাচারী ও সামরিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার সাফল্য বহুলাংশে সম্রাটের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল।
উরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীদের অধিকাংশই ছিলেন অযোগ্য, অপদার্থ ও বিলাসপ্রিয়। ৬৩ বছর বয়সে
সিংহাসনে বসে বৃদ্ধ ও বিলাসপ্রিয় বাহাদুর শাহের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সম্রাট
জাহান্দার শাহ সুরা ও নর্তকীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। সম্রাট ফারুখশিয়র অতিমাত্রায় প্রমোদাসক্ত।
ছিলেন। মহম্মদ শাহ ছিলেন সর্বপ্রকার বিলাসের প্রতি অনুরক্ত"। এই সব অলস, অকর্মণ্য ও ব্যাভিচারী
সম্রাটদের হাতে পড়ে মোগল সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। নাদির শাহের
আক্রমণের পর মোগল সাম্রাজ্য বস্তুত 'বহুমূল্য পরিচ্ছেদে ভূষিত একটি মৃতদেহ' (a gorgeously dressed corpse) ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।

(৪). অভিজাত শ্রেনীর অবক্ষয় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ : মোগল যুগের সূচনা-পর্বে অভিজাত সম্প্রদায় ছিলেন সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ। তাঁরা ছিলেন সদা-সচেতন, দক্ষ ও অনুগত এবং বহুক্ষেত্রে তারা দুর্বল মোগল সম্রাটদের পরিপূরক হয়ে কাজ করতেন। এই সব অভিজাতদের মধ্যে বৈরাম খাঁ, আবদুর রহিম, মহাবৎ খাঁ, মীর জুমলা, মানসিংহ প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর
মোগল রাজপরিবারের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে মোগল অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেও চরম অবক্ষয় দেখা
দেয়। সাম্রাজ্যের মঙ্গলের কথা চিন্তা না করে তারা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলাদলি
ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে শুরু করেন। ঔরঙ্গজেবের জীবদ্দশায় দরবারে ইরানী, তুরানী ও হিন্দুস্থানী নামে
তিনটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ শুরু
হলে তিন গোষ্ঠীর মধ্যে তৎপরতা শুরু হয় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীর সমর্থনে এগিয়ে
আসে। সম্রাট বাহাদুর শাহ ও জাহান্দার শাহের আমলে ইরানী গোষ্ঠীর নেতা জুলফিকার খাঁ ও আসাদ
খাঁ সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং তাঁরাই সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফারুখশিয়র দিল্লীর সিংহাসনে বসলে সৈয়দ আবদুল্লা খাঁ ও সৈয়দ হসেন আলির নেতৃত্বে হিন্দুস্থানী গোষ্ঠী সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তুরানী গোষ্ঠীর নেতা আমিন খাঁ ও চিন্ কিলিচ খাঁ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেন। ড. সতীশ চন্দ্র বলেন যে, এধরনের দলাদলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের পক্ষে শুভ হয়নি। এর ফলে জাতীয় জীবন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অক্ষম হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এবং রাষ্ট্র দ্রুত পতনের দিকে
অগ্রসর হয়। ড , কালীকিঙ্কর দত্ত-ও অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেন (The deterioration in the
character of the nobility during the eighteenth century had a large share in
hastening the decline of the Mughal Empire."-K. K. Data, wide An Advanced
History of India, P. 530)।

© 2018 SPediaXp™
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারন (Causes of the Downfall of the Mughal Empire) মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারন (Causes of the Downfall of the Mughal Empire) Reviewed by SGMoviesHD on August 28, 2018 Rating: 5

No comments:

Theme images by merrymoonmary. Powered by Blogger.